বাংলাদেশের আবৃত্তিচর্চা ।। শেখ সাদী মারজান

ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর । একটি মুক্তমঞ্চ। প্রতি বছর ডিসেম্বরের কোন এক শুক্রবারে ‘বৈকুণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমী’র আয়োজনে এই মঞ্চে ‘শিমুল মুস্তাফা’ ৭১টি কবিতা আবৃত্তি করেন। দর্শক-শ্রোতা উপস্থিত থাকেন দশ হাজারেরও বেশি। প্রায় পাঁচ ঘন্টা মুগ্ধচিত্তে তাঁরা আবৃত্তি শোনেন।
বিভিন্ন দিবস কেন্দ্র করে আবৃত্তি অনুষ্ঠান সাধারণ ব্যাপার। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আবৃত্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায়Ñ পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন, শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা, সংগীত-নৃত্য-আবৃত্তি মিলনায়ন, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র এবং চট্রগ্রামে- থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চট্রগ্রাম শিল্পকলা একাডেমী ইত্যাদি জায়গাগুলো আবৃত্তি অনুষ্ঠানের জন্য প্রসিদ্ধ। উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি প্রযোজনা-  শেষ দৃশ্যের পরে (নন্দনকানন), রাধা কৃষ্ণের পদাবলী (কন্ঠশীলন),তাহাদের কথা (নন্দনকানন), সত্যিকারের রূপকথা (বৈকুণ্ঠ), জননী যন্ত্রণা (বৈকুণ্ঠ) প্রাক যুগে পুরো ভাগে (আবৃত্তি সংসদ কুমিল্লা), অন্তরালে (নন্দনকানন), বৃদ্ধাশ্রম (ত্রিলোক বাচিক পাঠশালা)।  এছাড়াও বিভিন্ন দিবসে বেতার-টেলিভিশনে আবৃত্তির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পর আবৃত্তি বেতার কেন্দ্রভিত্তিক হয়ে পড়ে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে বেতারে কবি ফররুখ আহমদ, শাহ্দাৎ হোসেন, সিকান্দার আবু জাফর নিজের রচিত কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হন আরো অনেকে।
১৯৫২ সনের মহান ভাষা আন্দোলনের পর প্রতি বছর একুশে উদযাপনের অনুষ্ঠানমালায় আবৃত্তি একটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মঞ্চে, রাস্তায়, মোড়ে, মহল্লায়, মফস্বলে, বিভিন্ন অঞ্চলের শহীদ মিনারে আবৃত্তি জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ১৯৬৬,৬৮,৬৯,৭০,৭১ এর দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলনের জনজোয়ারকে উদ্দীপ্ত করার জন্য আবৃত্তি এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি-কথিকা পাঠ জাতীয় জাগরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এক সময় বাংলাদেশে যাঁরা আবৃত্তি করতেন তাঁরা সকলেই ছিলেন অভিনেতা, গায়ক, বেতার ঘোষক। আবৃত্তি ছিল তাঁদের কাছে সখের চর্চা বা দ্বিতীয় মাধ্যম।
বাংলাদেশে আবৃত্তি জনপ্রিয় হতে থাকে আশির দশকের শেষ দিক ও নব্বই দশকের শুরু  থেকে । নব্বইর দশকে ‘শিমুল মুস্তাফা’ দেশের আনাচে কানাচে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবৃত্তির অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আবৃত্তি পৌঁছে দেন গণমানুষের হৃদয়ে। তাঁর আবৃত্তির মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন কয়েকজন কবি, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেলাল হাফিজ।

১৯৭৫ সালে গঠিত হয় প্রথম আবৃত্তি সংগঠন ‘আবৃত্তি সংসদ’। এই দশকে দ্রুত বিকাশ লাভ করে আবৃত্তি সংগঠন-সেই সাথে সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তরিক যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। বর্তমানে সারাদেশে মোট ৪৭১টি আবৃত্তি সংগঠন রয়েছে এর মধ্যে ৩৭টি ঢাকায় । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ বৈকুণ্ঠ, কণ্ঠশীলন, মুক্তধারা, স্বরশ্রুতি, ত্রিলোক, সংবৃতা, বোধন, উচ্চারক, প্রমা, স্রোত, স্বরকল্পন, বোধন ও উদীচী। শিল্পকলা একাডেমীতে পৃথক আবৃত্তি বিভাগ রয়েছে।   আবৃত্তি কর্মশালা সাধারণত সংগঠন ভিত্তিক হয়ে থাকে । প্রতিটি কর্মশালায় অনেক তরুণ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবাই যে আবৃত্তি শিল্পী হয় তা নয়। অনেকে হয়ে থাকে আবৃত্তিকর্মী। আবৃত্তি শিল্পী না হতে পারলেও অন্তত বাংলা প্রমিত উচ্চারণ শিখতে পারে। টেলিভিশন সংবাদ পাঠকদের অধিকাংশই শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে দ্বারস্থ হয় আবৃত্তি সংগঠনগুলোর। 
আবৃত্তি অঙ্গনে যাঁদের কর্মকা- বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-  তারিক সালাাহউদ্দিন মাহমুদ, নরেন বিশ্বাস, গোলাম মুস্তাফা, আশরাফুল আলম,  হাসান ইমাম, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী, নাজিম মাহমুদ, আসাদুজ্জামান নুর,  ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, জয়ন্ত চক্রবর্তী,  শিমুল মুস্তাফা, মাহিদুল ইসলাম, আহকাম উল্লাহ, গোলাম সারওয়ার, মীর বরকত, রুপা চক্রবর্তী, রফিকুল ইসলাম, নাসিম আহমেদ, শাহাদাত হোসেন নিপু, মাসুম আজিজুল বাসার, মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল, মজুমদার বিপ্লব, ফখরুল ইসলাম তারা, রাশেদ হাসান, তামান্না তিথি, নাঈমা সিদ্দিকা, মেহেদী হাসান, বেলায়েত হোসেন, সাফিয়া খন্দকার রেখা, রেজীনাওয়ালী লীনা, সোহেল আনোয়ার, শামসুদ্দোহা, রাশেদ হাসান, নাজমুল আহসান, তামান্না ডেইজী, নাঈম সারোয়ার ও আবু নাছের মানিক। 
গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন- শিমুল মুস্তাফা, কামরুল হাসান মঞ্জু, মাহিদুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, নাজমুল আহসান ও মাসুম আজিজুল বাসার।
 আশি-নব্বইর দশকে আবৃত্তিচর্চা সংগঠন নির্ভর হলেও এখন আবৃত্তি কর্মীরা অনেকটা ব্যক্তিগতভাবেও চর্চা করতে পারে। বিশেষ করে তরুণরা বের হয়ে এসেছে সংগঠনের গণ্ডি থেকে। নিজেরাই আবৃত্তির এলবাম প্রকাশ ও মার্কেটিং করতে পারছে। অন্তর্জালের মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারছে তাদের কর্ম। এমনকি ওয়েলকাম টিউনে শোনা যায় তাদের আবৃত্তি । পেশাদারিত্বের জায়গায় কিছুটা হলেও পৌঁছাতে পেরেছে আবৃত্তিশিল্প।  বাংলাদেশে আবৃত্তি শিল্পের ভবিস্যৎ  সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল।

No comments:

স্বাধীন জাতির স্বাধীন‌ পিতা একটি সফল প্রযোজনা ।। শেখ সাদী মারজান

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিলো জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নুরুল হ...