কবিতার কথা ।। জীবনানন্দ দাশ

সকলেই কবি নয়। কেউ কউ কবি; কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে বিগত শতাব্দীর  ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্ত সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।
 বলতে পারা যায় কি এই সম্যক কল্পনা-আভা কোথা থেকে আসে? কেউ কেউ বলেন, আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সে কথা যদি স্বীকার করিতাহলে একটি সুন্দর জটিল পাককে যেন হীরার ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। হয়তো সেই হীরের ছুরি পরীদেশের, কিংবা হয়তো সৃষ্টির রক্ত চলাচলের মতোই সত্য জিনিস। কিন্ত মানুষের জ্ঞানের এবং কাব্য সমালোচনার-নমুনার নতুন নতুন আবর্তনে বিশ্লেষকরা এই আশ্চর্য গিঁটকে- আমি যতদূর ধারণা করতে পেরেছি- মাথার ঘাম ফেলে খসাতে চেষ্টা করবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ সম্বন্ধে কি বিশ্বাস করি - কিংবা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবার মতো কোনো সুস্থিরতা খুঁজে পেয়েছি কি না তা আমি এ প্রবন্ধে আলোচনা করবনা।
(অংশ বিশেষ)





কবি বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। 
জটিল ভাষায় সুগভীর বক্তব্য নিয়ে প্রথম থেকেই প্রবন্ধলেখক জীবনানন্দ স্বতন্ত্র হয়ে গেছেন। এর পর পরম বিশ্বাসে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধে তিনি সৎ ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার শর্ত নিরূপণ করেছেন, আধুনিকতার সঠিক পরিচয় নির্ণয় করেছেন এবং কখনো কখনো সমসাময়িক কবিতার মূল্যমান নির্ণয় করেছেন।
জীবনানন্দের প্রবন্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাঁর কবিতার কথা গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহ। কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে জীবনানন্দের কবিতা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে নিরেট পরিসরে। সমসাময়িককালে ইউরোপীয় ধাঁচে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার প্রবর্তন হয়, সে সম্পর্কে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ খুবই লক্ষ্যভেদী। কবিতাবিষয়ক চিন্তায় জীবনানন্দ’র দৃষ্টিভঙ্গি অভিনব বললে অত্যূক্তি হবে না। যুগ যুগ ধ’রে কবিতা বিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্র হলো: কবিতা কী, কী গুণে একটি রচনা কবিতা হয়ে উঠতে পারে। পরিবর্তে জীবনানন্দ সর্বাগ্রে কবি’র সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করাই শিরোধার্য করছিলেন, তিনি সর্বপ্রথমেই লিখলেন: “সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি....।” কে কবি? জীবনানন্দ জানালেন, কবির হৃদয়ে থাকবে কল্পনা ; সে কল্পনার ভিতরে থাকবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা। অধিকন্তু, জীবনানন্দ’র মতে, একজন কবির পশ্চাৎপটে ক্রিয়াশীল থাকে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক কবিদের বিভিন্ন কাব্যপ্রয়াস। এ কারণে, যার হৃদয়ে কল্পনার প্রতিভা নেই—আর কল্পনা যদিওবা থাকে, যদি না-থাকে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্রিক নির্যাস—তবে জীবনানন্দ তাঁকে, হতে পারেন তিনি বহুলপ্রজ এমনকী খ্যাতিমান কবিতালেখক, ‘কবি’ বলতে প্রস্তুত নন।

কল্পনার প্রতিভা কি—তা স্পষ্ট করেন নি জীবনানন্দ। ইমানুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) সময় থেকেই শিল্পসৃষ্টিতে রসধমরহধঃরড়হ বা কল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কান্ট যেমন ইঙ্গিত করেছেন, কল্পনার প্রতিভা হলো—যা দৃশ্যমান নয় তা প্রত্যক্ষ করবার—এবং একজন শিল্পীর জন্য—চিত্রায়নের ক্ষমতা; কবির জন্য ‘বোধ’ সৃষ্টির; তা হতে পারে স্মৃতিসঞ্জাত বা অভিজ্ঞতাপ্রসূত এমনকী হতে পারে, আলেকজান্ডার বমগার্টেনের (১৭১৪-১৭৬২) ভাষ্যে অভ‚তপূর্ব, অর্থাৎ অনদৃষ্ট, যা—এমনও হতে পারে—কেবল কবিতার মধ্য দিয়েই উপলব্ধ হবে। স্বীয় অভিজ্ঞতার গহন থেকেই উঠে আসে কল্পনালব্ধ বোধ, কবি তাকে ধারন করেন শব্দপুঞ্জে। তাহলে, জীবনানন্দের ভাষ্য ব্যাখ্যা ক’রে বলা যেতে পারে কবি তিনি যিনি অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারেন এবং পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন এই অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
কবির কাজ কবিতা সৃষ্টি করা কিন্তু কবি ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখে ফেলতে পারেন না কেননা, জীবনাননেদ্র ভাষায়, কবিতা ‘চিন্তার ব্যায়াম’ নয়। কবিতার জন্মরহস্য বর্ণনাতীত একটি ঘটনা। কোনও কবির পক্ষেই বলা সম্ভব নয়, আজ আমি একটি কবিতা লিখবো। কবিতা লেখার শর্ত হলো কবির মনে বিশেষ একটি ভাবনা বা চিন্তার স্বয়ম্ভূ স্ফূরণ। অনেক কবিই বলেছেন, প্রথমতঃ একটি পংক্তি হঠাৎ ক’রে জন্ম নেয়। জীবনানন্দের ভাষ্যে: কবিতা কোন এক বিশেষ মুহূর্তে কবিমনের সততাপ্রসূত অভিজ্ঞতা ও কল্পানপ্রতিভার দৈব সন্তান। কবিতার সংজ্ঞার্থে ‘দৈব সন্তান’ কথাটি অনিবার্য। দৃশ্যতঃ কবিতা মানুষের অধিগম্য শব্দসমষ্টির বিন্যাস মাত্র, কার্যতঃ গভীর সৌন্দর্যের উৎস। কবিতা শব্দের সমষ্টি হলেও মানুষের অনুভ‚তিতে সৃষ্টি করে বিশেষ একটা রস, সঞ্চারিত করে বিশেষ একটি আবেগ যা মানুষের উপলব্ধিতে জাগিয়ে তুলতে পারে বিশেষ তৃপ্তিবোধ এবং অনির্বচনীয় আনন্দোচ্ছলতা। কিন্তু কবিতা সকলের জন্যে নয়, অনেকের জন্যেও নয়। কবিতা কেবল কবিতাবোদ্ধাদের জন্য; জীবনানন্দ নিঃসংশয়ে মনে করেন শ্রেষ্ঠ কবিতা হলেই তা গণমানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠবে তা নয়।
জীবনানন্দ কাব্যের এবম্বিধ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অভিন্নমত পোষণ করেন নি। কবি শেলীও করেন নি। জীবনানন্দের মতে ‘কবিতা’ এবং ‘পদ্য’ অভিন্ন হতে পারে না; ‘পদ্য’ —যার ভিতর সমাজ-শিক্ষা, লোকশিক্ষা ও মতবাদের অধিষ্ঠানই মুখ্য—কবিতা থেকে পৃথক; পদ্যের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী, পাঠককে দিতে পারে না সম্ভোগানন্দ; পাঠক বড়জোর নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করতে পারে। সাংবাদিকী ও প্রচারমর্মী রচনার সঙ্গে কবিতার পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত জিনিসগুলোর ভিতর অভিজ্ঞতাবিশোধিত ভাবনা-প্রতিভার মুক্তি, শুদ্ধি ও সংহতি কিছুই নেই ; কবিতায় তা আছে।
কবির বৈশিষ্ট্য, কবিতা ও কবিতাসৃজন প্রক্রিয়া এই তিনটি বিষয় নিয়েই স্বীয় উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন জীবনানন্দ বিভিন্ন রচনায়। এক পর্যায়ে জীবনানন্দ সিদ্ধান্ত করেছেন, “কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুইরকম উৎসারণ”। ১৯৫৪ তে প্রকাশিত “শ্রেষ্ঠ কবিতার” ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “ . . . কবিতা অনেক রকম।” তিনি আরও লিখেছেন, “কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদেও উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য।” নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা-ও প্রণিধানযোগ্য, “আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মনে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আ্যখা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য--কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যেও কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন যে, কবি জীবনানন্দ দাশ নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র কাব্য-ভাষা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর গদ্য ভাষারীতিও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর প্রবন্ধগুলোর বাক্য গঠনরীতি সমসাময়িককালে সুপরিচিত ছিল না। এমনকী মনোযোগী পাঠকের কাছেও তা জটিল প্রতীয়মান হতে পারে। প্রবন্ধের ভাষায় জীবনানন্দ দাশ প্রায়শঃ একটি বাক্যের ভেতরে একাধিক অনুবাক্যকে ধারন করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে বাক্য কেবল দীর্ঘায়িত হয়নি, এর গঠনে অনুপ্রবেশ করেছে জটিলতা। তিনি বিশেষ ক’রে মূল বাক্যের জরায়ুতে যতি-চিহ্ন-চিহ্নিত নতুন বাক্য জুড়ে দিয়ে বক্তব্যকে সংহত রূপ দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। একটি বাক্যের শর্তসাপেক্ষে কমা বা সেমিকোলন দিয়ে আরেকটি বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়, পূর্ণরূপ বাক্য শেষে সেমিকোলন দিয়ে নতুন বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছে, পরবর্তী বাক্য পূর্ববর্তী বাক্যের বিশেষণ হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে বাক্য দীর্ঘ ও জটিল রূপ লাভ করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো একটি বাক্যের সমর্থনে আরেকটি বাক্য অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া যার উদাহরণ প্রথম বাক্যেও ‘কবিতার কথা’ নামীয় প্রবন্ধের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ।‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধটির প্রারম্ভিক বাক্যটি হ্রস্ব হলেও অব্যবহিত পরেই তিনি দীর্ঘ বাক্যের ঘন বুনোট গড়ে তুলেছেন। ‘এবং, ‘ও’ ইত্যাদি অন্বয়মূলক পদ এবং ’কমা’, ‘সেমিকোলন‘, ‘ড্যাশ‘ প্রভৃতি যতিচিহ্নের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এমন একটি গদ্যভাষা যার সঙ্গে সমকালীন বাঙালি লেখক-পাঠকের আদৌ পরিচয় ছিল না। বস্তুত তাঁর প্রবন্ধগুলোর বাক্য গঠনরীতি সমসাময়িককালে সুপরিচিত ছিল না। এমনকী মনোযোগী পাঠকের কাছেও তা জটিল প্রতীয়মান হতে পারে।

1 comment:

Indian media's information terrorism

 What is  Information terrorism? Information terrorism means misleading people with false information and creating terrorism or inciting t...