রুমের দরজা আটকিয়ে পড়তে বসেছে রিজুয়ানা। রুমের দরজা আটকে পড়তে বসার কারণ হচ্ছে- ছোট ভাই রাফিদের দুষ্টুমির অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার প্রচেষ্টা। রাফিদ এবার ছয় বছরে পা দিয়েছে। এরই মধ্যে তাকে দুষ্টুর শিরোমনি বললে ভুল হবে না। দুষ্টুমিতে অলিম্পিয়াড থাকলে সেখান থেকে সে হয়তো স্বর্ণপদক নিয়ে আসতো। অথবা দুষ্টুমির ওয়ার্ল্ড টুর্নামেন্ট থাকলে সে ট্রফি সে জয় করে নিয়ে আসতোই। দুষ্টুমির বিভিন্ন কৌশল সে আবিষ্কার করে। তাকে দুষ্টুমির গবেষকও বলা যেতে পারে। রাফিদ বিভিন্ন সময় নানা ধরনের কাণ্ড ঘটিয়ে তার দুষ্টুমির সক্ষমতার প্রমান দিয়েছে।
গত সপ্তাহে রিজুয়ানা ওর বান্ধবী অর্পার সাথে পদ্মবিল ভ্রমণের প্ল্যান করেছিল। বাসা থেকে প্রাইভেট এর উদ্দেশ্যে বের হবে। কিন্তু প্রাইভেট না পড়ে ওরা পদ্মবিলে যাবে। যাবতীয় প্ল্যান ওরা ফোনে ফোনে করেছে। সকালে যখন রিজুয়ানা বাসা থেকে বের হবে। তখন দরজার সামনে রাফিদ সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। রিজুয়ানা বললো-
– তুই সেজেগুজে কোথায় যাবি?
– তোমার সাথে পদ্মবিলে যাবো।
– আমি তো প্রাইভেটে পড়তে যাচ্ছি।
– না। তুমি পদ্মবিলে যাচ্ছো। আমি জানি। আমারে সাথে না নিলে আম্মু-আব্বুর কাছে সব বলে দিবো।
রাফিদের কথা শুনে রিজুয়ানা হতবাক! ও কী করে প্ল্যানটা জানলো! অগত্যা রাফিদকে সাথে নিয়ে পদ্মবিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। চোখ ধাধানো পদ্মবিলে গিয়ে রাফিদ প্রথমে বায়না ধরলো তাকে অনেকগুলো লালপদ্ম ছিড়ে দিতে হবে। বায়না অনুযায়ী তাকে অনেকগুলো লালপদ্ম ছিড়ে দেয়া হলো। তারপর সে দ্বিতীয় বায়না ধরলো নৌকায় চড়বে। কিন্তু আশেপাশে খালি নৌকা দেখা যাচ্ছে না। রাফিদ নাছোড়বান্দা; নৌকায় সে চড়বেই চড়বে। এরপর কান্না শুরু করে দিল। রিজুয়ানা রেগেমেগে রাফিদের গালে বসিয়ে দিল এক থাপ্পর। থাপ্পর খেয়ে রাফিদ আরো জোরে কান্না শুরু করে দিল। তখন রিজুয়ানা বললো-
– চুপ কর।
– না।
– স্পাইসি চিপস কিনে দেবো।
– আচ্ছা দাও।
রাফিদকে স্পাইসি চিপস কিনে দেওয়া হলো। স্পাইসি চিপস হাতে পেয়ে রাফিদ বললো-
– ধন্যবাদ।
রিজুয়ানার ফাইনাল পরীক্ষার আর কিছুদিন বাকী। রাতের খাবার শেষে রিজুয়ানা ওর রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেল- রাফিদ ওর পড়ার টেবিলের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। রিজুয়ানা বললো তুই এখান থেকে বের হ। রাফিদ মাথা নীচু করে রিজুয়ানার রুম থেকে বের হয়ে গেল। রাতে পড়া শেষ করে ঘুমানোর পূর্বে রিজুয়ানার ফোন বেজে উঠলো। সুমি ফোন করেছে। আগামী পরশু রীতার জন্মদিন। যেভাবেই হোক উদযাপন করতে হবে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এ মুহূর্তে জন্মদিন উদযাপন করলে বাসা থেকে রাগ করবে। তাই গোপনে উদযাপন করতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সুমির নানুর বাসায় উদযাপন করা হবে। কেকের অর্ডার, মোমবাতি, গিফট সবশেষে ফাটানোর জন্য ডিমের ব্যবস্থ্যা করতে হবে।
দুদিন পর দুপুরবেলা রিজুয়ানা বাসা থেকে বের হবে সুমির নানুর বাসার উদ্দেশ্যে; ঠিক তখনই দেখতে পেল রাফিদ নতুন জামা গায়ে, লাল প্যান্ট পড়ে, চুলে সিথি কেটে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! রিজুয়ানা জিজ্ঞেস করলোÑ
– তুই সেজেগুজে কোথায় যাবি?
– তোমার সাথে।
– আমার সাথে মানে?
– সুমি আপুর নানুর বাসায় যাবো।
– কেন?
– জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। আমারে সাথে না নিলে আম্মুরে সব বলে দিবো।
রিজুয়ানা বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে রাফিদের দিকে তাকায়। ও কী করে জানলো? এখন ওর সাথে না নিয়ে উপায় নেই। আম্মুরে বলে দিলে আব্বুও জানবে, তারপর রাহাত ভাইয়া জানবে। পিঠে ঢিপিস ঢিপিস পড়বে। অগত্যা রাফিদরে সাথে নিয়েই রওয়ানা দিল।
সুমির নানুর বাসায় আরো কয়েকজন বান্ধবী এসছে। রাফিদকে আদর করে কোলে নিতে চাইলো। কিন্তু সে কারো কোলে উঠলো না। চেয়ারে বসে একা একা কিছু ভাবতে লাগলো। এরই মধ্যে টেবিলে কেক রেখে মোমবাতি জ্বালানো হলো। সবাই একসাথে উঠলো হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ বলে ফু দিয়ে মোমবাতি নেভাতেই রাফিদ বললো- সবাই দেখো কেকটা কেমন কালো, বলেই ছুরি দিয়ে কেকে বাসিয়ে দিল এক কোঁপ। ওর কাণ্ড দেখে সবাই থ হয়ে গেল। এরপর রিজুয়ানা রাগে গড়গড় করতে লাগলো। ডিম ফাটানো আর হলো না।
রিজুয়ানা বাসায় ফিরে চুপচাপ বসে আছে। এতো কষ্টের আয়োজন রাফিদ একাই মাটি করে দিল। এর মধ্যে রাফিদ এসে বললো-
-আপু তোমরা আজ ডিম ফাটাওনি কেনো?
-তুই যা এখান থেকে।
-আচ্ছা। আমি যাচ্ছি। আম্মু তোমারে খেতে ডাকছে।
রাফিদ অবশ্য আগেই খেয়ে নিয়েছে। খাওয়া শেষে রুমে এসে দেখলো রাফিদ খাটের কোনে বসে আছে। রিজুয়ানা বললো-
– তুই তোর কাজে যা।
রাফিদ যাচ্ছি বলে স্কেল নিয়ে দৌড় দিলো।
রিজুয়ানা চিন্তায় পড়ে গেল। সব প্ল্যান রাফিদ কী করে বুঝে যায়। ওকে এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। প্রাইভেটে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে আলোচনা করতে লাগলো। রাফিদকে বাদ দিয়ে কী করে পরবর্তী কোনো কিছু করা যায়। সবশেষে বুদ্ধি বের হলো। সকালে রাফিদ ঘুম থেকে উঠার আগেই বাসা থেকে বের হতে হবে। তাহলে রাফিদ আর সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরতে পরবে না।
কিছুদিন পর পয়লা বসন্ত । স্কুলে বসন্তের অনুষ্ঠান হবে। রিজুয়ানা ও তার বান্ধবীরা প্ল্যান করলো, ওই দিন সকলেই বাসন্তী রঙয়ের ড্রেস পড়বে। হাফ পিরিয়ডের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। রিজুয়ানা সকাল আটটার সময় বাসা থেকে বের হবে। কারণ রাফিদ সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে। রাফিদ ঘুম থেকে জাগার আগেই যদি রিজুয়ানা বাসা থেকে বের হতে পারে তাহলে রাফিদকে আর সাথে নিতে হবে না।
বসন্তের প্রথম দিন সকালে রিজুয়ানার দরজায় ঠকঠক শব্দ। রাফিদ চিল্লাপাল্লা করছে। আপু উঠো। সকাল হয়ে গেছে। রিজুয়ানা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো তখন সকাল ০৭ঃ১০ বাজে। দরজা খুলে বিস্ময়ে হতবাক। রাফিদ বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিজুয়ানা জিজ্ঞেস করলো-
– তুই পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েছিস কেন?
– আজ বসন্তের প্রথম দিন। তাই বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েছি। তোমার সাথে স্কুলে যাবো।
– আমার সাথে স্কুলে কেন যাবি?
– তোমাদের স্কুলে আজ অনুষ্ঠান আছে, তাই যাবো।
রিজুয়ানা রাগে ফেটে পড়লো। রাফিদকে সাথে নিয়েই রওয়ানা দিলো স্কুলের দিকে। বান্ধবীরা সবাই বললো- রাফিদ আজও চলে এসেছে। রিজুয়ানা সবাইকে আজ সকালের কথা বললো। সবাই শুনে মন্তব্য করলো যে, রাফিদের ঘাড়ে হয়তো জ্বীন তাই সে সবকিছু জেনে যায়। আর এ জন্যই অনেক দুষ্টুমি করে।
কয়েকদিন পর রাতে রিজুয়ানা ইংরেজি বই খুঁজে পাচ্ছিল না। বই খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেল খাটের নীচে বইটি পড়ে আছে। খাটের নীচে হাত দিলো বই উঠানোর জন্য। হাতে নাগাল পাচ্ছিল না। অগত্যা মাথা ঝুকে বই উঠাতে গেল। বই হাতে নিয়ে মাথা বের করার সময় কিসের সাথে যেন গুতা লাগলো। তবে খাটের কাঠের সাথে নয়। টর্চ লাইট এনে জ¦ালিয়ে দেখতে পেল খাটের নীচের দিকের কাঠের সাথে স্কস্টেপ দিয়ে কিছু একটা লাগানো। তারপর সেটা খুলে এনে দেখতে পেল একটা পুরনো মোবাইল। তারপর চিনতে পারলো; এটা রাহাত ভাইয়ার পুরনো একটা মোবাইল। এটা হাতে নিয়ে রাফিদ খেলতো। বাটনে চাপ দিতেই স্ক্রিনে লাইট জ¦লে উঠলো। তারমানে এটি এখনও সচল রয়েছে। কিন্তু এটি এখানে স্কস্টেপ দিয়ে কে লাগিয়ে রেখেছে? নিশ্চয়ই রাফিদ এটি এখানে লুকিয়ে রেখেছে। রিজুয়ানা বাসার কাউকে কিছু না বলে মোবাইল ফোনটি ওর ব্যাগে রেখে দিল। পরের দিন রাফিদ রিজুয়ানার রুমে আসলো। রিজুয়ানা কিছু না বলে কৌশলে দেখতে লাগলো রাফিদ কি করে। রাফিদ খাটের কোনে বসে রইলো। তারপর একটা কলম নিয়ে খাটের নীচে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর সে খাটের নীচে গেল ফেলে দেওয়া কলমটি তুলতে। কলম তুলতে খাটের নীচে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রইলো। তারপর বের হয়ে এলো। বেচারার মন খারাপ হয়ে গেল। আনমনে কিছু ভাবতে লাগলো যেন। রাতে ঘুমানোর সময় রাফিদ উৎপাত শুরু করে দিলো। সে ঘুমাতে চাইছে না। ঘুম পাড়ানোর জন্য আম্মু গান শোনাল, ছড়া শোনাল, গল্প শোনাল। কিন্তু সে কিছুতেই ঘুমাবে না। তারপর আম্মু জিজ্ঞেস করলো এমন করছে কেন? রাফিদ অভিযোগ দিলো রিজুয়ানা আপু তার খেলার পুরনো মোবাইল নিয়ে গেছে। মোবাইল না দিলে সে এখন কিছুতেই ঘুমাবে না। আম্মু বললো তুমি তোমার ট্যাব চালাও। ট্যাবে গান শোনো, কার্টুন দেখো। রাফিদ বললো- না, আমার ওই মোবাইলটি খুবই দরকার। তুমি রিজুয়ানা আপুক বলো আমার মোবাইলটি দিতে। এরপর জোরে কান্না শুরু করে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বললো নানুরে ফোন দাও। আমি নানুর সাথে কথা বলবো। নানুকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো রিজুয়ানা আপু আমার মোবাইল নিয়ে গেছে; দিচ্ছে না। তুমি দিতে বলো। নানু রাহাতকে কল করে বললো, রিজুকে বলো রাফিদের মোবাইল ফেরত দিতে। রাহাত রিজুয়ানার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো ওটা ওর সেই পুরাতন মোবাইল, যেটি সে পাঁচ বছর আগে কিনেছিল। দুই বছর আগে ব্যবহার বাদ দিয়ে ঘরে ফেলে রেখেছিল। রাহাত তার পুরাতন মোবাইলটি হাতে নিয়ে স্ক্রিনে টাচ করে দেখলো মোবাইলটি এখনও সচল। লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল ওখানে লাইভ ইয়ার্ড রেকর্ড নামে নতুন ধরনের একটা এ্যাপ চালু আছে। পরে রাহাতের মনে পড়লো এরকম একটা এ্যাপ রাফিদের ট্যাবেও সে দেখেছিল। তারপর রাফিদের ট্যাব হাতে নিয়ে ওই এ্যাপের ভিতর প্রবেশ করেই রেকর্ড অপশনে ঢুকে সে দেখতে পেল ওই মোবাইলের এ্যাপের সাথে রাফিদের ট্যাবের কানেকশন রয়েছে। ওখানকার সবকিছু এখানে রেকর্ড হয়ে আছে। এই রেকর্ডের মাধ্যমে রাফিদ রিজুয়ানার সমস্ত প্ল্যান জেনে যায়। রাহাত সব বুঝেও চুপচাপ থাকলো। ছয় বছরের রাফিদের উদ্ভাবিত এই টেকনোলোজি সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।